সোমবার, ১৬ জুন, ২০২৫, ২ আষাঢ়, ১৪৩২
Live TV
সর্বশেষ

সাকরাইন আহে পৌষের শেষ দিন

জনতার ইশতেহার ডেস্ক
১২ জানুয়ারি, ২০২৫, ১১:৫৭ অপরাহ্ণ
সাকরাইন আহে পৌষের শেষ দিন
১২ জানুয়ারি, ২০২৫, ১১:৫৭ অপরাহ্ণ

ফাইল ছবি

সাকরাইন উৎসব- মূলত পৌষ সংক্রান্তি বা ঘুড়ি উৎসব নামেও পরিচিত। বাংলাদেশে শীত মৌসুমের বাৎসরিক উদ্ যাপন ঘুড়ি উৎসব, ঘুড়ি উড়িয়ে পালন করা হয়৷ সংস্কৃত শব্দ ‘সংক্রান্তি’ ঢাকাইয়াদের অপভ্রংশে সাকরাইন রূপ নিয়েছে। পৌষ ও মাঘ মাসের সন্ধিক্ষণে অর্থাৎ পৌষ মাসের শেষদিন সারা ভারতবর্ষে সংক্রান্তি হিসাবে উদযাপিত হয়। তবে পুরান ঢাকায় পৌষসংক্রান্তি বা সাকরাইন সার্বজনীন ঢাকাইয়া উৎসবের রূপ নিয়েছে। বর্তমানে দিনভর ঘুড়ি উড়ানোর পাশাপাশি সন্ধ্যায় বর্ণিল আতশবাজি ও রঙবেরঙের ফানুশে ছেয়ে যায় বুড়িগঙ্গা তীরবতী শহর পুরোনো ঢাকার পুরো আকাশ। এক কথায় বলা যায় সাকরাইন হচ্ছে এক ধরনের ঘুড়ি উৎসব।

বাংলা বর্ষপঞ্জিকার নবম মাস পৌষ মাসের শেষ দিনে আয়োজিত হয় যা গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জিকার হিসেবে জানুয়ারি মাসের ১৪ অথবা ১৫ তারিখে পড়ে। বাংলায় দিনটি পৌষ সংক্রান্তি এবং ভারতীয় উপমহাদেশে মকর সংক্রান্তি নামে পরিচিত।

সাকরাইন উৎসব পৌষ সংক্রান্তি। সাকরাইন উৎসবে অন্য নাম সংক্রান্তি। খতুভিত্তিক, এঁতিহ্যবাহী উদযাপন ঘুড়ি-উড়ানো, আতশবাজি ও রঙবেরঙ ফানুশ উড়ানো তারিখ বর্তমানে এবারে ১৪ জানুয়ারি পড়েছে, আজ সাকরাইন। ১৭৪০ সালের এই দিনে মোগল আমলে নায়েব-ই-নাজিম নওয়াজেশ মোহাম্মদ খানের আমলে ঘুড়ি উড়ানো হয়। সেই থেকে এই দিনটি কেন্দ্র করে বর্তমানে এটি একটি অন্যতম উৎসব পরিণত হয়েছে।

বাংলাদেশের প্রাচীন উৎসব সমূহের মধ্যে পুরোনো ঢাকার সাকরাইন উৎসব অন্যতম। যদিও এটা সমগ্র বাংলাদেশব্যাপী পালিত হয় না কিন্তু খুব জনপ্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশি সংস্কৃতি। এটাকে ঐক্য এবং বন্ধুতের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। ঢাকার, আকাশে উড়ে নানারকমের ঘুড়ি। ঐতিহ্যগত ভাবে ঢাকাইয়াদের ঘুড়িগুলোর নামও সেরকম।

যেমন: চোখদার, পানদার, গাহেল, পেটকাট্টা, লম্বা লেণ্জালা ইত্যাদি। চোখদার বলা হচ্ছে ঘুড়ির উপর অংশে দুটোচোখ আছে। পানদার বলা হচ্ছে ঘুড়ির বুকে হার্ট বা পানের চিহ্ন আছে। আর গাহেল বলা হচ্ছে খাড়া বা পাশাপাশি অর্ধেক অর্ধেক আলাদা আলাদা রঙের ঘুড়ি। এই রঙের ঘুড়িটাই যখন কোনাকুনি অর্ধেক অর্ধেক হয় তখন এটিই হয়ে যায় পেটকাট্টা ঘুড়ি আবার কখনো তিন পরতের ঘুড়িকেও বলা হচ্ছে পেটকাট্টা ঘুড়ি। আর কিছু ঘুড়ি যেগুলো বিভিন্ন রঙের থাকে সেগুলোর মধ্যে লম্বালেজ জুড়ে লম্বা লেণৃজালা ঘুড়ি হিসেবে উড়ানো হয়। এই জাতীয় ঘুড়ি অবশ্যই সাকরাইনে দেখা যাবে না। এই জাতীয় ঘুড়ি অন্যান্য সময় আকাশে উড়ে আয়াশ করে। বেলা যত গড়িয়েছে পুরান ঢাকার আকাশে ততই ছড়িয়েছে ঘুড়ির রং। এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি, সব ছাদেই যেন আনন্দ আয়োজন।

আমরা ঘুড়ি উৎসব সাকরাইন নিয়ে জানতে চাইলে পুরোনো ঢাকা নারিন্দার আবুল কালাম আজাদ মিন্টু ভাই বললেন, সাকরাইন আর সাকরাইন নাই। এইটা শুধু একটা উৎসবই হয়ে গেছে। ঢাকাইয়ারা আজ সংখ্যায় সংখ্যালঘু।

তিনি আরো বলেন, ‘আমরা ছোটবেলায় দেখেছি – বাবা ভাইরা ঘুড়ি উড়াতো আর নীচে থেকে মা আর ভাবিদের বানানো গরম গরম পিঠা আসতো। গরম গরম পিঠা খাওয়া আর ঘুড়ি উড়ানো। আর সারা মহল্লা হঠাৎ হঠাৎ চিৎকার দিয়ে উঠতো বাকাট্টা গুডিড বলে ঘুড়ি কাটলেই। আজ সেইদিন কই!

আকাশজুড়ে নানা রঙের ঘুড়ি উড়ে দিনভর। আর সন্ধ্যা হলে শুরু হয় আরেক মাতম। সারাদিনের বাজানো মাইকের গান রূপ নেয় আলো ঝলমল ডিজে পার্টিতে। সাহসী যুবকেরা মুখে কেরোসিন নিয়ে হাতে রাখা আগুনের মশালে ছুড়ে দিচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে অভূতপূর্ব এক দুঃসাহসিক দৃশ্য। কে রুখে তারে। সারারাত চলে এ মাতম ক্লান্ত দেহে ঘুমোতে যায় ভোরে।

ঘুড়ি উৎসবের আগের দিনটা আরো উৎসব মুখোর। কিশোররা ছুটে চলে বাশের পট্টিতে সবচেয়ে বড় লগ্গা বা চিকন লম্বা বাশ কিনতে ঘুড়ি ধরার জন্য। আর কিছুলোক চলে যায় সুতা মানজা দেয়ার রং, চুড়(কাচের ঘন গুড়া) আর সিরিস কেনার জন্য। চুলায় গরম করা সিরিস আর রঙের্ মিশ্রনে কাচের মিহি গুড়ার চুড়ে চলে সুতা মান্জা দেওয়া। রাতভর চলে সূতা মাঞ্জা দেয়া। আর পাশেই ভেসে আসে গরম পিঠার সুমিষ্ট গন্ধ, আহ!

কিছু মৌলবাদী সুযোগ নেয় পুরোনো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী এই সংস্কৃতি বন্ধে থানায় সাধারণ ডায়েরী করে। এভাবেই পালিত হয় পুরোনো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী এই ঘুড়ি উৎসব বা সাকরাইন।
সবশেষে আবারও ঢাকাইয়া ভাষায় বলতে হয় ‘সাকরাইন আহে পৌষের শেষদিন’।

জই২৪ ডটকম/ফিচার